---Advertisement---

SIR: নাগরিক যাচাই না কি রাজনৈতিক চাল!

Souris Dey

Published

দেবরাজ সাহা, বর্ধমান: বাংলা সহ দেশের বারোটি রাজ্যে শুরু হতে চলেছে SIR (Special Intensive Revision)। সাধারণভাবে এটি নির্বাচন কমিশনের একটি নিয়মিত প্রশাসনিক প্রক্রিয়া। যেখানে ভোটার তালিকা, সংশোধন ও নতুন নাম সংযোজন করা হয়। কিন্তু এর গভীরে তাকালে বোঝা যায় এটি কেবল নামের তালিকা নয়, এটি আমাদের নাগরিক অস্তিত্বের একটি দলিল, আমাদের গণতন্ত্রে অংশগ্রহণের ন্যূনতম অধিকার।

বিজ্ঞাপন

আজকের দিনে পরিচয়ের রাজনীতি যত জটিল হয়ে উঠেছে, ততই এই ধরনের প্রক্রিয়াগুলি এক গভীর সামাজিক তাৎপর্য বহন করে। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছেন, সোমবার রাত ১২টা থেকে ভোটার তালিকা ‘ফ্রিজ’ করে দেওয়া হবে। অর্থাৎ এরপর থেকে পুরনো তথ্য বন্ধ হয়ে যাবে এবং নতুন করে যাচাইয়ের প্রক্রিয়া শুরু হবে। BLO বা বুথ-লেভেল অফিসাররা মঙ্গলবার থেকেই মাঠে নামবেন। তাঁরা প্রতিটি পাড়ায়, প্রতিটি ঘরে গিয়ে যাচাই করবেন কারা ভোটার তালিকায় আছেন, কারা বাদ পড়েছেন, আর নতুনভাবে কাকে যুক্ত করা যায়। তিন দফায় ভেরিফিকেশন চলবে। যাতে কোনো যোগ্য নাগরিক বাদ না যান এবং কোনো ভুয়ো নাম যুক্ত না হয়। এছাড়াও প্রবীণ ও অক্ষম নাগরিকদের জন্য অনলাইন ফর্ম পূরণের সুবিধা রাখা হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে প্রযুক্তির নাগরিকীকরণের এক ইতিবাচক দিক। কিন্তু এর সঙ্গে একটা বড় প্রশ্নও থেকে যায়, আমরা কি যথেষ্ট সচেতন?

প্রায়ই দেখা যায়, নাগরিকরা ভোটের ঠিক আগেই বুঝতে পারেন তাঁদের নাম তালিকায় নেই, বা ঠিকানায় ভুল হয়েছে। অথবা তথ্যগত ত্রুটি। অথচ সংশোধনের এই সময়টাতেই সেই ভুল শুধরে নেওয়ার সুযোগ থাকে। আমাদের অনেকের কাছে ভোট কেবল নির্বাচনের দিনে একদিনের ঘটনা, কিন্তু SIR-এর মতো প্রক্রিয়াই আসলে সেই প্রস্তুতির ভিত্তি তৈরি করে। এখানেই নাগরিক দায়বদ্ধতার প্রশ্নটি এসে দাঁড়ায়। গণতন্ত্র কেবল শাসকের দায় নয়, একজন নাগরিকেরও প্রতিশ্রুতি। তালিকায় নিজের নাম নিশ্চিত করা, তথ্য যাচাই করা, প্রয়োজনে আপডেট করা, এগুলোই সেই প্রতিশ্রুতির সূক্ষ্ম প্রকাশ।

অনেক সময় শহুরে উদাসীনতার আড়ালে আমরা ভুলে যাই যে এই ছোট ছোট কাজগুলোই রাষ্ট্রের বৃহৎ কাঠামোকে সচল রাখে। তবে এই প্রক্রিয়ায় কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। মাঠ পর্যায়ে BLO-দের কাজ নিঃসন্দেহে কঠিন। আর রাজনৈতিক চাপ, তথ্যভ্রান্তি ও প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতা অনেক সময় স্বচ্ছতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাই নির্বাচন কমিশনের উচিত পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও তদারকির মাধ্যমে এই ব্যবস্থাকে আরও নির্ভরযোগ্য করে তোলা। তেমনি নাগরিক সমাজ, স্থানীয় সংগঠন ও রাজনৈতিক দলগুলোরও উচিত মানুষকে সচেতন করা যাতে কেউ বাদ না পড়ে, কেউ বিভ্রান্ত না হয়।

See also  বঙ্গবন্ধু পদক ২২' পাচ্ছেন বর্ধমানের মানব মুখোপাধ্যায়

SIR এর এই প্রক্রিয়াকে অনেকেই নিছক সরকারি কাজ হিসেবে দেখছেন। কিন্তু আমার মতে, এটি আসলে গণতন্ত্রের আত্মপরীক্ষা। ভোটার তালিকা মানে কেবল নামের তালিকা নয়, এটি নাগরিক স্বীকৃতির এক নৈতিক প্রতিফলন। আমরা প্রায়ই দেখি, ভোটের সময় অভিযোগ ওঠে কেউ ভোট দিতে পারেননি, কারও নাম বাদ গেছে, আবার কোথাও মৃত বা অপ্রাসঙ্গিক নাম রয়ে গেছে তালিকায়। এই অভিযোগগুলোর মূল কারণ নাগরিক সচেতনতার অভাব এবং প্রশাসনিক অসতর্কতা, যা SIR-এর মতো প্রক্রিয়ার সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে রোধ করা সম্ভব। তবে শুধু প্রশাসন নয়, দায় আমাদেরও।

গণতন্ত্রে নাগরিকের ভূমিকা কেবল ভোট দেওয়া নয়, ভোটের আগে নিজের অস্তিত্ব নিশ্চিত করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। নিজের নাম তালিকায় আছে কি না, ঠিকানা সঠিক কি না, বা নতুন প্রজন্মের নাম যুক্ত হয়েছে কি না এই ছোটখাটো যাচাইয়ের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পরিপক্বতা। SIR আমাদের সেই প্রশ্নটাই মনে করিয়ে দেয় আমরা কতটা সচেতন নাগরিক। আমরা কি সত্যিই আমাদের অধিকারকে মূল্য দিই, নাকি প্রশাসনের ওপরই সব দায় চাপিয়ে নিশ্চিন্ত থাকি?

আমার বিশ্বাস, এই প্রক্রিয়া যত বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে, ততই আমাদের গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে। প্রত্যেক নাগরিকের নাম তালিকায় থাকা মানে একেকটি জীবন রাষ্ট্রের গণনায় ধরা পড়ছে যার কণ্ঠস্বর ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠন করবে। অন্যদিকে, যদি নাগরিক নিজে উদাসীন থাকে, তাহলে গণতন্ত্র ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তাই SIR কেবল একটি নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নয় এটি আমাদের নাগরিক চেতনার প্রতিফলন। কিন্তু বাস্তবে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। অনেক সময় BLO-দের সংখ্যা যথেষ্ট নয়, তথ্য যাচাইয়ের প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়। এবং সাধারণ মানুষের কাছে পরিষ্কার ধারণা পৌঁছায়।

বিশেষত গ্রামীণ এলাকায় অনেকে জানেনই না যে এখনই তালিকা সংশোধনের সময় চলছে। ফলে সচেতনতার অভাবে বহু যোগ্য ভোটার বাদ পড়ে যান। আরও একটি সমস্যা হল প্রযুক্তিগত ব্যবধান। অনলাইন ফর্মের সুযোগ থাকলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ এখনও ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় অভ্যস্ত নন। তাই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য বাস্তবে পুরোপুরি সফল হতে হলে সচেতনতা এবং সহায়তা দুই দিকেই জোর দিতে হবে।

See also  এবার ভাতারে করোনা আক্রান্ত ৭ বছরের শিশু, নতুন করে আতঙ্ক

বাংলার প্রেক্ষাপটে, যেখানে রাজনৈতিক মেরুকরণ গভীর, সেখানে SIR-কে ঘিরে আশঙ্কা এবং প্রত্যাশা দুটোই রয়েছে। একদিকে শাসকদল বলছে, “সব নাগরিকের নাম যেন তালিকায় থাকে, সেটাই লক্ষ্য।” অন্যদিকে বিরোধীরা অভিযোগ তোলে—“বিভিন্ন এলাকায় ভুয়ো নাম রয়ে গেছে বা নতুন ভোটার যুক্ত হতে পারছেন না।” রাজ্যে বা কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দল প্রায়ই এই প্রক্রিয়ায় প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করে। কখনও নাম বাদ দেওয়া, কখনও নির্দিষ্ট এলাকা বিশেষে যোগ-বিয়োগের অভিযোগ ওঠে। তাই নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা এখানে সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।

বাস্তবতা হচ্ছে রাজনৈতিক স্বার্থের টানাপোড়েনের মাঝেও যদি প্রশাসন নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছভাবে এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে পারে, তাহলেই SIR সত্যিকারের অর্থে মানুষের প্রক্রিয়া হয়ে উঠবে, রাজনৈতিক তকমা ছাড়াই।‌ তবে গণতন্ত্রের সাফল্য কখনো সংখ্যার উপর নির্ভর করে না, এটি নির্ভর করে সেই সংখ্যাগুলোর স্বচ্ছতার উপর। SIR সেই স্বচ্ছতাকে প্রতিষ্ঠা করার লড়াই, যেখানে রাজনীতি ও প্রশাসনের সীমানা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে সাধারণ মানুষ তার নিজের পরিচয়ের স্বীকৃতির অপেক্ষায়। তবে এই উদ্যোগের সাফল্য নির্ভর করবে নাগরিক অংশগ্রহণের ওপর।

বি: দ্র: – প্রতিবেদক বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র

শেয়ার করুন 🤝🏻

Join WhatsApp

Join Now
---Advertisement---