দেবরাজ সাহা, বর্ধমান: ৪ নভেম্বর থেকে পশ্চিমবঙ্গে শুরু হয়েছে ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন (Special Intensive Revision)বা সংক্ষেপে এসআইআর। প্রায় তেইশ বছর পর এই প্রক্রিয়া ফের শুরু হওয়ায় একদিকে প্রশাসনিক তৎপরতা বাড়লেও, অন্যদিকে সৃষ্টি হয়েছে বিভ্রান্তি, সংশয় এবং ভয়ের আবহ। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে এখন বুথ লেভেল অফিসাররা (BLO) ঘরে ঘরে গিয়ে ভোটারদের এনুমারেশন ফর্ম বিলি করছেন, তথ্য সংগ্রহ করছেন। গণতন্ত্রে ভোটার তালিকা শুদ্ধকরণ নিঃসন্দেহে জরুরি, কিন্তু প্রশ্ন উঠছে এই প্রস্তুতি কতটা পরিপক্ব, কতটা স্বচ্ছ, এবং কতটা মানবিক?

কমিশন জানিয়েছে, এবার নাগরিকরা অনলাইনেও ফর্ম পূরণ করতে পারবেন। কিন্তু প্রথম দিন থেকেই সার্ভার বিপর্যয়, ওয়েবসাইট ডাউন থাকা, লগইন সংক্রান্ত সমস্যা দেখা দেয়। বহু মানুষ অভিযোগ জানিয়েছেন যে, পোর্টাল খোলা যাচ্ছিল না, অথবা তথ্য সেভ হচ্ছিল না। প্রযুক্তির যুগে এমন মৌলিক প্রশাসনিক ব্যর্থতা নিঃসন্দেহে প্রশাসনের প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে। আমার মতে গণতন্ত্রে তথ্যপ্রযুক্তি নাগরিকের বন্ধু হওয়ার কথা, কিন্তু আমাদের বাস্তবতায় সেটি প্রায়ই নাগরিকের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। যাঁরা রাজ্যের বাইরে কর্মরত, বা যাঁরা প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ নন তাঁদের কাছে অনলাইন প্রক্রিয়াটি এক রীতিমতো পরীক্ষার মতো। বিশেষত বয়স্ক নাগরিকদের কাছে এটি প্রায় অতিক্রম্য বাধা। ফলে “ডিজিটাল বিভাজন”-এর বাস্তবতা আবারও সামনে এসেছে।
প্রশ্ন উঠছে, প্রযুক্তি কি সকলের জন্য সমানভাবে সহজলভ্য? ২০০২ সালের পর রাজ্যে প্রথমবার এই নিবিড় সংশোধন হচ্ছে। অর্থাৎ দুই দশকেরও বেশি পুরোনো ভোটার তালিকা এখন মিলিয়ে দেখা হচ্ছে বর্তমান তথ্যের সঙ্গে। কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ৩২ শতাংশ ভোটারের তথ্য পুরোনো তালিকার সঙ্গে মিলেছে, বাকিদের যাচাই চলছে। এই বিশাল ব্যবধানই দেখাচ্ছে সময়ের সঙ্গে সমাজ, জনবিন্যাস ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা কতটা বদলে গেছে। গ্রাম শহরে পরিণত হয়েছে, পরিবার ছোট হয়েছে, অভিবাসন বেড়েছে। ফলে পুরোনো তথ্যের সঙ্গে নতুন তথ্যের তুলনা করতে গিয়ে তৈরি হচ্ছে ভুল, বিভ্রান্তি ও অনিশ্চয়তা। দুই দশকের ব্যবধান মানে কেবল সময় নয়। এটি রাজনীতি, জনসংখ্যা, অর্থনীতি ও নাগরিক চেতনার পরিবর্তনের প্রতিফলন। প্রশাসন যদি তা বুঝতে ব্যর্থ হয়, তবে এই প্রক্রিয়া গণতান্ত্রিক নয়, বরং যান্ত্রিক হয়ে দাঁড়াবে।
কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী, যাঁদের তথ্য পুরোনো তালিকার সঙ্গে মেলে না, তাঁদের নথি যাচাই করতে হবে। কিন্তু এখানেই নতুন বিপত্তি। গ্রামীণ ও আর্থিকভাবে দুর্বল মানুষের কাছে জন্মসনদ, ঠিকানার প্রমাণ বা আধার কার্ডের মতো নথি সবসময় থাকে না। অনেক সময় ঠিকানা বদল, বিবাহ বা কর্মসূত্রে স্থানান্তরিত হওয়া ইত্যাদি কারণে মানুষ নিজেই নিজের প্রমাণপত্র জোগাড় করতে হিমশিম খান। ফলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন তাঁদের নাম বাদ পড়তে পারে ভোটার তালিকা থেকে। যেখানে রাষ্ট্র নাগরিকের পরিচয় নিশ্চিত করার কথা, সেখানে নাগরিককেই নিজের অস্তিত্ব প্রমাণে দৌড়ঝাঁপ করতে হচ্ছে।
বিভিন্ন জেলার খবরে লক্ষ করেছি, BLO বা স্থানীয় কর্মীদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। কোথাও ফর্ম বিলি না করে ফেলে রাখা হয়েছে, কোথাও আবার রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগ উঠছে। বিরোধীরা দাবি করছে এসআইআর প্রক্রিয়া প্রশাসনের নয়, বরং রাজনৈতিক পক্ষপাতের শিকার হচ্ছে। তৃণমূল কংগ্রেস ইতিমধ্যেই অভিযোগ তুলেছে যে, এসআইআর-এর নামে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে। রেড রোড থেকে জোড়াসাঁকো পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নেতৃত্ব দিয়েছেন বিশাল মিছিলে। তাঁদের বক্তব্য, এই প্রক্রিয়া নিরপেক্ষ নয়; এর আড়ালে ভোটার তালিকা থেকে নির্দিষ্ট শ্রেণিকে বাদ দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। অন্যদিকে, বিজেপির একাংশের দাবি, রাজ্য প্রশাসন নিজেই কমিশনের প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। ফলে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের এক নতুন রাজনৈতিক টানাপোড়েনও স্পষ্ট হচ্ছে।
প্রশাসনের লক্ষ্য অবশ্যই তালিকার শুদ্ধতা বৃদ্ধি করা। কিন্তু বাস্তবে যদি সেই শুদ্ধতার দোহাই দিয়ে মানুষ বাদ পড়ে, তাহলে এই প্রচেষ্টা গণতন্ত্রের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায়। নাগরিক পরিচয় যে রাষ্ট্রের দান নয়, সেটি এই সময় বারবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া জরুরি। একজন নাগরিকের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া মানে তাঁর সামাজিক মর্যাদা ও আত্মসম্মানের ওপর আঘাত। এসআইআর প্রক্রিয়া নিছক ভোটার তালিকা সংশোধনের উদ্যোগ নয়; এটি রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতা, প্রশাসনিক দক্ষতা ও নাগরিক আস্থার এক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাক্ষেত্র।
রাজনীতির কোলাহলের বাইরে, এই প্রক্রিয়াটি নাগরিক ও রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস পুনর্গঠনের সুযোগ এনে দিতে পারত। যদি প্রশাসন সেটিকে সহানুভূতি ও স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিচালনা করত। নির্বাচন কমিশন যেহেতু সাংবিধানিক সংস্থা, তাই তার নিরপেক্ষতা নিয়েই এখন প্রশ্ন উঠছে। বিরোধীরা অভিযোগ করছে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপে রাজ্যের কমিশন অফিসারদের ওপর চাপ তৈরি হচ্ছে। অন্যদিকে কমিশন বলছে, রাজ্যের রাজনৈতিক দলগুলিই মাঠ পর্যায়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। এই পারস্পরিক অভিযোগের মধ্যে আসল প্রশ্নটা হারিয়ে যাচ্ছে।
আজকের এসআইআর প্রক্রিয়া আমাদের চোখে এক আয়না যেখানে প্রশাসনিক জটিলতা, রাজনৈতিক টানাপোড়েন এবং নাগরিক অনিশ্চয়তা একসঙ্গে প্রতিফলিত হচ্ছে। ভোটার তালিকার শুদ্ধতা যেমন দরকার, তেমনি প্রয়োজন নাগরিকের সম্মান, আস্থা ও অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা। গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি তালিকার নিখুঁততায় নয়, বরং মানুষের আস্থায়। তবে সবশেষে একটিই প্রশ্ন থেকে যায় — মানুষ কি তাঁর ভোটাধিকার নিয়ে নিরাপদ বোধ করছেন?
বি: দ্র: – লেখক ও সম্পাদকীয় বিশ্লেষক









